ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

মামলায় ফাঁসিয়ে, গ্রেপ্তারের ভয় ও ইয়াবা ঢুকিয়ে অর্থ আদায় করছে পুলিশ

ঋত্বিক নয়ন ।।

অভিযোগের ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে পারছে না পুলিশ। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তো অতি পুরনো। ঘুষ ছাড়া সেবা দানে অনীহা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলকে তুষ্ট করার চেষ্টা, মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া ও গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের চেষ্টার অভিযোগও বিস্তর রয়েছে। অভিযোগের সত্যতাও কম নয়। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে পুলিশের মধ্যে জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা না থাকায় এ সমস্যাটা হচ্ছে। কোন থানা এখনো পর্যন্ত সাধারণ মানুষের আশা ভরসার স্থল হয়ে উঠতে পারেনি। এ জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করা হয়। পাশাপাশি মান্দাতা আমলের আইন, পুলিশ বাহিনীর মানসিকতা, প্রচলিত সিস্টেম, সামাজিক সামগ্রিক পরিবেশ, নিয়োগ পদ্ধতি, পোস্টিংবদলিপদোন্নতি প্রক্রিয়াসহ নানা সমস্যার যাঁতাকলে পড়ে পুলিশ রয়ে গেছে আজো সেই তিমিরে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের সাথে যার তেমন কোন পার্থক্য নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মসহ নানা অপরাধে গত ৭ বছরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ৩ হাজার ৮৩৬ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। চলতি বছরেও অসংখ্য পুলিশের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এরপরও থামানো যাচ্ছে না পুলিশের অপরাধ কর্মকাণ্ড। অভিযোগ রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের উপরই ন্যস্ত হওয়ায় প্রতিকার মিলছে না কিছুতেই। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাগণ পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো অস্বীকার না করে বলেন, মানুষ হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ঠিকই। তবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পুলিশ বলে ছাড় দেয়া হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মো: ইকবাল বাহার এ প্রসঙ্গে গতকাল রাতে আজাদীকে বলেন, ‘আইন তৈরি হয়েছে আইন ভাঙার জন্য। পুলিশও মানুষ। তারাও অপরাধ করে। মানুষ যদি অপরাধ না করতো, তবে আইন আদালত কোন কিছুর প্রয়োজন হতো না। এরাও মানুষ, এরাও ভুল করে। তার সাজাও দেওয়া হয়। একবার সাজা দিলে সে কখনো করবে না, এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই।’ পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত পুলিশ করা প্রসঙ্গে সিএমপি কমিশনার বলেন, পুলিশ তদন্তকারী সংস্থা। কার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে, সে কি পুলিশ নাকি অন্য কেউ, সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য বিষয় হলো তদন্ত। পুলিশ বলে অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছে, এমন নজির দেখানো কঠিন হবে। অন্ততঃ আমি সিএমপি কমিশনার হিসেবে থাকাকালীন সময়ে এ বিষয়ে যথেষ্ট কঠোর। অনুসন্ধানে জানা গেছে সারা দেশের মতো চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশকে (সিএমপি) রক্ষায় নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন পুলিশ কমিশনার মো: ইকবাল বাহার। দফায় দফায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা, পুলিশ সদস্যদের সাথে মতবিনিময়, থানা পুলিশের কার্যক্রম মনিটরিংসহ নানাবিধ কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলছে। সিএমপি কমিশনার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেকোনো ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায়ভার ঐ ব্যক্তিকেই বহন করতে হবে। এর দায় পুলিশ বিভাগ নেবে না। এরপরও অপরাধ প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের। সিএমপি সূত্র জানায়, সাত বছরে (২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত) সিএমপিতে ৩ হাজার ৮৩৬ সদস্যকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গুরুতর শাস্তি পেয়েছেন ৩০৭ জন, লঘু শাস্তি পেয়েছেন ৩ হাজার ৫২৯ জন। এর বাইরেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২ হাজার ৬২ সদস্যকে তিরস্কার করা হয়। সতর্ক করা হয় ৭৬৫ জনকে। পিডি (পানিশমেন্ট ড্রিল) ও শ্রমসাধ্য দায়িত্ব দেয়া হয় ৭০২ জনকে। এ সময় ৬২ এসআই (নিরস্ত্র), ৬ সার্জেন্ট, ৩ এসআই (সশস্ত্র), ১৮ এএসআই (নিরস্ত্র), ১৩ এএসআই (সশস্ত্র), ৪ সহকারী ট্রাফিক উপপরিদর্শক (এটিএসআই), ৭ নায়েক এবং ১৯৪ কনস্টেবলসহ ৩০৭ জন গুরুতর শাস্তি পেয়েছেন। গত ৬ অক্টোবর অস্ত্র বিক্রির সময় র‌্যাবের হাতে নিউমার্কেট থেকে আটক হয় সিএমপির গোয়েন্দা শাখার দুই কর্মকর্তা এসআই উজ্জ্বল কান্তি দাস এবং এএসআই আনিসুর রহমান। র‌্যাব অস্ত্রের ক্রেতা সেজে তাদের আটক করে। আটকের পর র‌্যাব তাদের পরিচয় জানতে পারে। পরে তাদের সিএমপির এক কর্মকর্তার হেফাজতে দেয়া হয়। ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছেন সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য।

ইয়াছমিন আক্তার জুলি ও ফারজানা আক্তার নিলা নামে দুই গৃহবধূ অভিযোগ করেন, তাদের বিরুদ্ধে গত ২০১৪ সালে চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা করেছে প্রতিপক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে জামিন নিয়েছেন এবং চট্টগ্রাম আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। কিন্তু সিআইডি কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ও তার সঙ্গের পুলিশ পরিচয়দানকারী কিছু ব্যক্তি হাজিরা দেয়ার সময় আদালতে ও তাদের আসা যাওয়ার পথে নিয়মিত হয়রানি করছে মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে বলে। গতকাল এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে মহানগর হাকিম আবু সালেহ মোহাম্মদ নোমানের আদালতে অভিযোগ করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট অনুপম চক্রবর্তী। তিনি আজাদীকে জানান, মহামান্য আদালত অভিযোগ পরবর্তী কার্যদিবসে তদন্ত কর্মকর্তাকে সশরীরে হাজির থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তার উপস্থিতিতে এ বিষয়ে শুনানি হবে। গত ৯ অক্টোবর রাত বারোটার দিকে মো. আনিসুর রহমান রুবেল নামে এক ব্যক্তি কর্মস্থল থেকে তার বাসা বাকলিয়া থানাধীন শান্তি নগর যাচ্ছিলেন। শাহ আমানত হাউজিং সোসাইটির খাল পাড় সড়ক পথের মাঝখানে আরাফাত ও খোকন নামে সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই সদস্য তাকে তল্লাশির নামে পকেটে ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকিয়ে তাকে মাদক ব্যবসার অভিযোগে চালান করার ভয় দেখায়। পরে পকেটে থাকা দশ হাজার টাকা নিয়ে তাকে বাড়াবাড়ি করলে জেলে পুরার হুমকি দিয়ে চলে যায়। গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল চকবাজার থানায়। সেই ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার না করে উল্টো থানায় বসে খোশগল্প করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ৭ জুলাই চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজ আহমেদকে বদলির আদেশ দেন পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার। গত ৪ জুন হালিশহর থানাধীন কে ব্লকস্থ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কিছু উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী জহিরুল আলম ভূঁইয়ার বাড়িতে হামলা চালায়। হামলায় জহিরুল আলমসহ তাঁর স্ত্রী শেখ রেহানা আলম এবং তাঁর দুই মেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ছাত্রী তাহমিনা আলম অনু ও মহসিন কলেজ এর ছাত্রী জাহানারা আলম আহত হন। বিষয়টি থানা পুলিশকে অবহিত করলেও মামলা নেওয়া হয়নি। ২০ জানুয়ারি বন্দর থানাধীন কলসিদীঘির পাড় এলাকায় সোলায়মান নামে এক ব্যবসায়ীকে ডেকে নিয়ে নির্যাতন ও টাকা আদায়ের অভিযোগে ইপিজেড থানার এএসআই এমদাদুল হককে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়।

এক ব্যবসায়ীকে ফাঁসানোর অভিযোগে সিএমপির তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ১৮ জানুয়ারি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন তৎকালীন সিএমপি কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল। অভিযুক্ত তিন পুলিশ হলেনএসআই শাহাদাত হোসেন, এসআই জুয়েল সরকার ও শেখ সজীব। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর নগরের লাভ লেন এলাকায় জুয়েলারি দোকানের মালিক দোলন বিশ্বাসের কাছ থেকে র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ১০২ ভরি ওজনের আটটি সোনার বার ছিনতাই করা হয়। এ ঘটনার পরদিন তিনি বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে কোতোয়ালী থানায় একটি ছিনতাইয়ের মামলা করেন। প্রাথমিকভাবে তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মিজানুর রহমান ও কনস্টেবল খান এ আলমকে পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত শেষে কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) প্রিটন সরকার দুই পুলিশসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১০ মে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর তাদের এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। চলতি বছরের ১০ মে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বায়েজিদ থানাধীন সুপার রিফাইনারি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাস, এসআই একরামুল হক ও সুজন বিশ্বাসকে বরখাস্ত করা হয়। গেল বছরের ১৯ জুন পাঁচলাইশ থানার পুলিশ হেফাজতে বীমা কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামানের মৃত্যুর ঘটনায় নগরজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। টাকার জন্য নির্যাতন করে বীমা কর্মকর্তাকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করে ৬ পুলিশ সদস্য, আনসার ও পুলিশের সোর্সসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন নিহতের স্ত্রী। মামলায় পাঁচলাইশ থানার এসআই আমির হোসেন, বাকলিয়া থানার এএসআই মো. এনায়েত হোসেন, পাঁচলাইশ থানার কনস্টেবল মিজানুর রহমান, মোছলেম, খোকন মিয়া, পাঁচলাইশ থানার গাড়িচালক কনস্টেবল আকবর, আনসার কনস্টেবল শাহীনুর আলম, পুলিশের সোর্স মো. জামাল ও হুমায়ন কবির এবং ঘটনাস্থলে থাকা হারুনুর রশিদ ডিউককে আসামি করা হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক লোক মামলা করেছে আদালতে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে পুলিশের অভিযোগের তদন্ত পুলিশ করে বলে প্রতিকার মিলে না। অথচ পুলিশ রেগুলেশনস অব বাংলাদেশ, পুলিশ অ্যাক্ট১৮৬১তে পুলিশের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার বিধান উল্লেখ রয়েছে। আইন ভঙ্গ করলে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে। কিন্তু পুলিশের ঘটনা পুলিশকে দিয়ে তদন্ত করার কারণে অনেক ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হয় না। এছাড়া বেশির ভাগ অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য আজাদীকে বলেন, প্রতিবছর যতজন পুলিশ বিভিন্ন অভিযোগে চাকরিচ্যুত হয়, এ দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও দেখাতে পারবেন না। অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে অথচ ছাড় পেয়েছে পুলিশ সদস্য হওয়ায়, এটা কোথাও ঘটে না। পুলিশের তদন্ত পুলিশ করে বলেই কোন ছাড় দেওয়া হয় না। আজাদী

 

পাঠকের মতামত: